কিডনি রোগের কারণ, লক্ষণ এবং কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

কিডনি হল আমাদের শরীরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত তরল এবং ইলেকট্রোলাইটগুলি অপসারণ করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে, হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং রক্ত ​​জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।

প্রতিটি কিডনি প্রায় ১০-১২ সেন্টিমিটার লম্বা, ৫-৭ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ৩-৪ সেন্টিমিটার পুরু। তারা আমাদের পিঠের নিচের অংশে, মেরুদণ্ডের উভয় পাশে অবস্থিত। কিডনিগুলি প্রতিদিন প্রায় ২ লিটার প্রস্রাব উৎপন্ন করে।

কিডনির প্রধান কাজ

কিডনির প্রধান কাজগুলি হল:

  • রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ: কিডনিগুলি রক্ত থেকে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে। এই বর্জ্য পদার্থগুলি প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়।
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: কিডনিগুলি রেনিন নামক একটি হরমোন তৈরি করে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখা: কিডনিগুলি ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • রক্ত ​​জমাট বাঁধতে সহায়তা: কিডনিগুলি প্রোটিন তৈরি করে যা রক্ত ​​জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য বহুল ব্যবহৃত দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হল এসিআর (Albumin Creatinine Ratio) এবং জিএফআর (Glomerular Filtration Rate)

এসিআর হল রক্তে অ্যালবুমিন এবং ক্রিয়েটিনিনের অনুপাত। অ্যালবুমিন একটি প্রোটিন যা রক্তের প্রবাহে থাকে। ক্রিয়েটিনিন হল একটি বর্জ্য পদার্থ যা কিডনি দ্বারা শরীর থেকে বের করে দেওয়া হয়।

একটি স্বাভাবিক এসিআর মান 30 মিলিগ্রাম/গ্রাম বা তার কম। এসিআর মান 30 মিলিগ্রাম/গ্রাম বা তার বেশি হলে তা কিডনির ক্ষতির লক্ষণ হতে পারে।

জিএফআর হল কিডনির প্রতি মিনিটে কত পরিমাণ রক্ত পরিশোধন করতে পারে তার একটি পরিমাপ। জিএফআর মান 60 মিলিলিটার/মিনিট বা তার বেশি হলে তা স্বাভাবিক। জিএফআর মান 60 মিলিলিটার/মিনিট বা তার কম হলে তা কিডনির ক্ষতির লক্ষণ হতে পারে।

এসিআর এবং জিএফআর পরীক্ষার মধ্যে পার্থক্য

  • এসিআর হল একটি সহজ এবং সস্তা পরীক্ষা।
  • জিএফআর হল একটি আরও জটিল পরীক্ষা যা কিডনির কার্যকারিতা আরও সঠিকভাবে পরিমাপ করে।

কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য কোন পরীক্ষাটি করা হবে তা ডাক্তার নির্ধারণ করবেন।

কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সময় অন্যান্য পরীক্ষাও করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • রক্ত পরীক্ষা: রক্ত পরীক্ষায় রক্তে ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ফসফেট এর মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এই মাত্রাগুলি কিডনির কার্যকারিতা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
  • প্রস্রাব পরীক্ষা: প্রস্রাব পরীক্ষায় প্রস্রাবে প্রোটিন, রক্ত, চিনি, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং অন্যান্য উপাদানের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
  • আল্ট্রাসাউন্ড: আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় কিডনির আকার, আকৃতি এবং অবস্থান পরিদর্শন করা হয়।
  • CT স্ক্যান: CT স্ক্যান পরীক্ষায় কিডনির ভেতরে থাকা কাঠামোগুলির বিস্তারিত ছবি পাওয়া যায়।
  • MRI: MRI স্ক্যান পরীক্ষায় কিডনির ভেতরে থাকা কাঠামোগুলির আরও বিস্তারিত ছবি পাওয়া যায়।

এই পরীক্ষাগুলির ফলাফলের ভিত্তিতে ডাক্তার কিডনির অবস্থা নির্ণয় করে এবং পরবর্তী চিকিৎসার পরামর্শ দেন।

কিডনি রোগের কারণ

কিডনি রোগের অনেকগুলি কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস কিডনি রোগের সবচেয়ে সাধারণ কারণ। ডায়াবেটিসে শরীর রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা কিডনিগুলির ক্ষতি করতে পারে।
  • উচ্চ রক্তচাপ: উচ্চ রক্তচাপ কিডনিগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা ক্ষতি করতে পারে।
  • মূত্রনালীর সংক্রমণ: মূত্রনালীর সংক্রমণ যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে কিডনিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
  • কিডনি পাথর: কিডনি পাথর কিডনিগুলিতে বড়, শক্ত স্ফটিক গঠনের কারণে হয়। এগুলি কিডনিগুলির ক্ষতি করতে পারে।
  • মূত্রনালীর ক্যান্সার: মূত্রনালীর ক্যান্সার কিডনিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
  • কিডনি ক্যান্সার: কিডনি ক্যান্সার কিডনিগুলির ক্ষতি করতে পারে।

কিডনি রোগের অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
  • ধূমপান
  • অ্যালকোহল সেবন
  • কিছু ওষুধ
  • পরিবেশগত দূষণ
  • কিডনিতে জন্মগত ত্রুটি

কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু কারণ হল:

  • বয়স: বয়স্কদের মধ্যে কিডনি রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • পরিবার ইতিহাস: যদি আপনার পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস থাকে তবে আপনার ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালীর সংক্রমণ, মূত্রনালীর ক্যান্সার বা কিডনি ক্যান্সারের মতো অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

কিডনি রোগের লক্ষণ

কিডনি রোগের লক্ষণগুলি সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে স্পষ্ট হয় না। তবে, রোগটি আরও খারাপ হয়ে গেলে, লক্ষণগুলি আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে।

কিডনি রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
  • প্রস্রাবের রঙ লালচে বা বাদামী হওয়া
  • প্রস্রাবে ফেনা ভাব হওয়া
  • প্রস্রাবে আমিষ বা অ্যালবুমিন থাকা
  • প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া
  • পা ফুলে যাওয়া
  • ক্লান্তি
  • দুর্বলতা
  • ওজন কমে যাওয়া
  • ক্ষুধামন্দা
  • শরীরে চুলকানি

কিডনি রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে কিছু লক্ষণ খুব সাধারণ, যেমন ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। এই লক্ষণগুলি অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণেও হতে পারে, তাই যদি আপনি এই ধরনের লক্ষণগুলি অনুভব করেন তবে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।

কিডনি রোগের কিছু লক্ষণ, যেমন প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া, আরও গুরুতর। এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা করা গুরুত্বপূর্ণ।

কিডনি রোগের লক্ষণগুলির তীব্রতা রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করে। প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগের কোনও লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে, রোগটি আরও খারাপ হয়ে গেলে, লক্ষণগুলি আরও স্পষ্ট এবং গুরুতর হয়ে ওঠে।

কিডনি রোগের লক্ষণগুলি যদি চিহ্নিত করা হয় তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি রোগের অগ্রগতি ধীর বা থামানো যেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ চিরতরে এলার্জি দূর করার উপায়

কিডনিতে কি কি রোগ হয়

কিডনিতে বিভিন্ন ধরণের রোগ হতে পারে। কিছু সাধারণ ধরণের কিডনি রোগের মধ্যে রয়েছে:

  • কিডনি সংক্রমণ: কিডনি সংক্রমণ, যা নেফ্রাইটিস নামেও পরিচিত, কিডনির সংক্রমণ। এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের কারণে হতে পারে। কিডনি সংক্রমণের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, প্রস্রাবে ব্যথা, প্রস্রাবে রক্ত এবং প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া।
  • কিডনিতে পাথর: কিডনিতে পাথর হল কিডনিতে শক্ত, কঠিন পদার্থের জমা। কিডনিতে পাথরের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে তীব্র ব্যথা, প্রস্রাবে ব্যথা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং রক্তে রক্ত।
  • ক্রনিক কিডনি রোগ: ক্রনিক কিডনি রোগ হল কিডনির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। এটি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা অন্যান্য রোগের কারণে হতে পারে। ক্রনিক কিডনি রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে প্রস্রাবে পরিবর্তন, শরীরে তরল জমা, এবং উচ্চ রক্তচাপ।
  • কিডনি ব্যর্থতা: কিডনি ব্যর্থতা হল কিডনির সম্পূর্ণ ক্ষতি। এটি ক্রনিক কিডনি রোগের চূড়ান্ত পর্যায়। কিডনি ব্যর্থতার লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, শরীরে তরল জমা, এবং উচ্চ রক্তচাপ। কিডনি ব্যর্থতার চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন।

কিডনি রোগের ঝুঁকি কমাতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে:

  • **স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা
  • **নিয়মিত ব্যায়াম করা
  • **পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা
  • **লবণ গ্রহণ সীমিত করা
  • **ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন এড়ানো
  • **নিয়মিত রক্তচাপ ও রক্ত শর্করা পরীক্ষা করা
  • **কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা

কিডনি ভালো রাখার উপায়

কিডনি ভালো না থাকলে শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কিডনির সুস্থতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

কিডনি ভালো রাখার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে:

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা: কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা জরুরি। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। পানি পান করলে কিডনিতে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে যাওয়া সহজ হয়।
  • স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া: কিডনি ভালো রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি, ডাল, এবং ওটস রাখতে হবে। এছাড়াও, চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণ, এবং অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা: উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে গেলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। তাই রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
  • ধূমপান না করা: ধূমপান কিডনির ক্ষতি করতে পারে। তাই ধূমপান ত্যাগ করা জরুরি।
  • অতিরিক্ত ওজন না থাকা: অতিরিক্ত ওজন কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করা: নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং কিডনির কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকে।
  • ব্যথার ওষুধ কম ঔষধ খাওয়া: ব্যথার ওষুধের কিছু কিছু প্রকার কিডনির ক্ষতি করতে পারে। তাই ব্যথার ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা: ৪০ বছর বয়স পেরোনোর পর প্রতি বছর কিডনির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। এতে কিডনির কোনো সমস্যা থাকলে তা শনাক্ত করা সহজ হয়।

কিডনি রোগের ঝুঁকি কমাতে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

কিডনি রোগের চিকিৎসা রোগের ধরন এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে। প্রাথমিক পর্যায়ে, কিডনি রোগের চিকিৎসায় লাইফস্টাইল পরিবর্তন, ওষুধ, বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে, কিডনি রোগ যদি অগ্রসর হয়, তাহলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে।

পাঠকের মন্তব্য:

Check Also

ছোলা খাওয়ার উপকারিতা

ছোলা খাওয়ার উপকারিতা: ছোলা কেন আপনার খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত কাঁচা?

ছোলা বাঙালির খাদ্যতালিকার একটি অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে রোজার মাসে ইফতারের পাতে ছোলা থাকতেই হবে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *