বারোমাসি লাউ চাষ পদ্ধতি

বারোমাসি লাউ একটি উচ্চ ফলনশীল এবং দ্রুত বর্ধনশীল সবজি। এটি সারা বছরই চাষ করা যায়। বারোমাসি লাউয়ের জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • বীজসুন্দরী
  • রুপালি
  • সুখবর
  • জামদানি
  • বিইউ হাইব্রিড লাউ-১

বীজসুন্দরী জাতের লাউয়ের ফল ছোট আকারের হয়। রুপালি জাতের লাউয়ের ফল মাঝারি আকারের হয়। সুখবর জাতের লাউয়ের ফল বড় আকারের হয়। জামদানি জাতের লাউয়ের ফল লম্বা আকারের হয়। বিইউ হাইব্রিড লাউ-১ জাতের লাউয়ের ফল লম্বা আকারের হয় এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়।

বারোমাসি লাউ চাষ পদ্ধতি

লাউ চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে লাউ একটি জনপ্রিয় সবজি। এটি শীতকালীন সবজি হলেও বারোমাসি লাউ চাষ করে সারা বছর লাউ পাওয়া যায়। বারোমাসি লাউ চাষের জন্য জমি নির্বাচন, বীজ বপন, চারা রোপণ, পরিচর্যা, ও পোকামাকড় দমন গুরুত্বপূর্ণ। বারোমাসি লাউয়ের চাষ পদ্ধতি নিম্নরূপ:

জমি নির্বাচন

বারোমাসি লাউ চাষের জন্য দোআঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। মাটি ভালোভাবে চাষ করে নিতে হবে। জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করলে ফলন ভালো হয়।

বীজ বপন

বারোমাসি লাউয়ের বীজ সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বপন করা হয়। বীজ বপনের আগে বীজগুলোকে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ভালো হয়। বীজগুলোকে ১.৫-২ সেন্টিমিটার গভীরে লাগাতে হবে।

চারা রোপণ

বীজ গজানোর পর ১৫-২০ দিন বয়সের চারা মাঠে রোপণ করা হয়। চারা রোপণের সময় মাদা তৈরি করে নিতে হবে। মাদার আকার ৫০x৫০x২৫ সেমি হতে হবে। মাদা তৈরির সময় প্রতি মাদে ১০-১২ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম এমপি এবং ২০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের পর পানি সেচ দিতে হবে।

সার প্রয়োগ

বারোমাসি লাউ চাষে সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চারা রোপণের পর প্রতি মাসে ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ফুল আসার সময় প্রতি গাছে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ

বারোমাসি লাউ চাষে নিয়মিত সেচ প্রয়োজন। শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিন সেচ দিতে হবে। তবে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা যাবে না।

আগাছা পরিচর্যা

লাউ গাছের গোড়ার আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। আগাছা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।

ফল সংগ্রহ

লাউ গাছের ফুল ফোটার পর ২৫-৩০ দিন পর ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল কাঁচা অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত।

পোকামাকড় দমন

লাউ গাছের প্রধান পোকামাকড় হলো:

  • মাজরা পোকা
  • থ্রিপস পোকা
  • ফল ছিদ্রকারী পোকা
  • মিলিবাগ পোকা

এই পোকামাকড় দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশক ব্যবহারের আগে অবশ্যই কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে।

বারোমাসি লাউ চাষে কিছু টিপস

  • বাউনি দেয়া লাউয়ের ফলন বেশি হয়।
  • লাউ গাছের গোড়ায় সাদা মাছি বা পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
  • লাউ গাছের গোড়ায় রসুন বা পেঁয়াজ পাতা ছিটিয়ে দিলে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়।

আরো পড়ুন ঃ ধুন্দল এর উপকারিতা

লাউ চাষ পদ্ধতি

লাউ গাছে কত দিন পর পর সার দিতে হয়?

লাউ গাছে কত দিন পর পর সার দিতে হয় তা গাছের বয়স, জলবায়ু, এবং মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে। সাধারণত, লাউ গাছে প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর সার দেওয়া হয়।

লাউ গাছের সার প্রয়োগের সময়সূচী নিম্নরূপ:

বীজতলা তৈরির সময়

বীজতলা তৈরির সময় প্রতি বর্গমিটার জমিতে ১০-১৫ কেজি গোবর সার, ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি, এবং ৫০-৭৫ গ্রাম এমপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।

চারা রোপণের পর

চারা রোপণের পর ১৫-২০ দিন পর প্রতি বর্গমিটার জমিতে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে দিতে হবে।

ফুল আসার সময়

ফুল আসার সময় প্রতি বর্গমিটার জমিতে ১০০-১৫০ গ্রাম টিএসপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।

ফল ধরার সময়

ফল ধরার সময় প্রতি বর্গমিটার জমিতে ১০০-১৫০ গ্রাম এমপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।

লাউ গাছে সার প্রয়োগের সময় মাটির উর্বরতা পরীক্ষা করে নিতে হবে। মাটি যদি বেশি উর্বর হয় তাহলে সার প্রয়োগের পরিমাণ কমাতে হবে। আবার, মাটি যদি কম উর্বর হয় তাহলে সার প্রয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

লাউ গাছে সার প্রয়োগ করার সময় সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। যাতে করে সার গাছের শিকড়ের কাছে পৌঁছাতে পারে।

বারোমাসি লাউ চাষের সুবিধা

বারোমাসি লাউ চাষের অনেক সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো:

  • সারা বছর লাউ পাওয়া যায়: বারোমাসি লাউ চাষ করে সারা বছর লাউ পাওয়া যায়। এতে করে লাউয়ের চাহিদা পূরণ করা যায় এবং লাউয়ের দাম ভালো পাওয়া যায়।
  • ফলন ভালো হয়: বারোমাসি লাউ চাষ করলে ফলন ভালো হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১৫-২০ টন লাউ উৎপাদন করা সম্ভব।
  • দাম ভালো পাওয়া যায়: বারোমাসি লাউ চাষ করলে দাম ভালো পাওয়া যায়। বাজারে লাউয়ের চাহিদা বেশি থাকায় দাম ভালো পাওয়া যায়।
বারোমাসি লাউ চাষের সুবিধা

বারোমাসি লাউ চাষের অসুবিধা

বারোমাসি লাউ চাষের কিছু অসুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো:

  • পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়: বারোমাসি লাউ চাষে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়। বিশেষ করে মাজরা পোকা, থ্রিপস পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা, এবং মিলিবাগ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। এই পোকামাকড়ের আক্রমণে লাউ গাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং ফলন কমে যেতে পারে।
  • রোগের আক্রমণ বেশি হয়: বারোমাসি লাউ চাষে রোগের আক্রমণ বেশি হয়। বিশেষ করে পাতা ঝরা রোগ, ফল ঝরা রোগ, এবং শিকড় পচা রোগের আক্রমণ বেশি হয়। এই রোগের আক্রমণে লাউ গাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং ফলন কমে যেতে পারে।
  • পরিচর্যার পরিমাণ বেশি হয়: বারোমাসি লাউ চাষে পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা করতে বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, এবং পোকামাকড় ও রোগ দমন।

এই অসুবিধাগুলো থেকে বাঁচতে হলে সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজন। নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, এবং পোকামাকড় ও রোগ দমন করলে পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ থেকে লাউ গাছকে রক্ষা করা সম্ভব।

লাউ এর উপকারিতা ও অপকারিতা

লাউ এর উপকারিতা

লাউ একটি পুষ্টিকর সবজি যা বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। এটিতে প্রচুর পরিমাণে পানি, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। লাউয়ের কিছু উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হল:

  • শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করে: লাউয়ের ৯৬% পানি। তাই এটি শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করে এবং ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে: লাউয়ের ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
  • ওজন কমাতে সাহায্য করে: লাউয়ের ক্যালোরির পরিমাণ কম এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি। তাই এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
  • হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো: লাউয়ে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
  • ত্বকের জন্য ভালো: লাউয়ে ভিটামিন এ এবং সি রয়েছে, যা ত্বকের জন্য ভালো।
  • চুলের জন্য ভালো: লাউয়ে ভিটামিন এ এবং সি রয়েছে, যা চুলের জন্য ভালো।

লাউ এর অপকারিতা

লাউয়ের কোনো উল্লেখযোগ্য অপকারিতা নেই। তবে, কিছু ক্ষেত্রে লাউ খেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন:

  • অ্যালার্জি: লাউয়ের প্রতি কিছু মানুষের অ্যালার্জি হতে পারে। লাউ খেলে যদি কারো শরীরে চুলকানি, ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব বা বমি হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে লাউয়ের প্রতি অ্যালার্জিক।
  • পেটে ঠান্ডা লাগা: লাউয়ের ঠান্ডা প্রকৃতি রয়েছে। তাই যাদের পেটে ঠান্ডা লাগে, তাদের লাউ খাওয়া উচিত নয়। লাউ খেলে তাদের পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
  • হজমের সমস্যা: লাউয়ের ফাইবার বেশি থাকে। তাই যাদের হজমের সমস্যা আছে, তাদের লাউ কম খাওয়া উচিত। লাউ খেলে তাদের পেট ফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া হতে পারে।

লাউয়ের অপকারিতা এড়াতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে হবে:

  • লাউয়ের প্রতি অ্যালার্জি আছে কিনা, তা আগে থেকেই জেনে নিন।
  • যাদের পেটে ঠান্ডা লাগে, তারা লাউ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • হজমের সমস্যা আছে কিনা, তা দেখে লাউ খান।

লাউয়ের উপকারিতা পেতে এটি নিয়মিত খাওয়া উচিত। তবে, অপকারিতা এড়াতে উপরের বিষয়গুলি খেয়াল রাখুন।

উপসংহার

বারোমাসি লাউ চাষ একটি লাভজনক চাষ। এ চাষে নিয়মিত পরিচর্যা ও যত্ন নিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।

পাঠকের মন্তব্য:

Check Also

ধুন্দল এর উপকারিতা

ধুন্দল এর উপকারিতা, রোগ-বালাই দমন ও চাষ পদ্ধতি

ধুন্দল একটি জনপ্রিয় সবজি যা সারা বাংলাদেশে চাষ করা হয়। এটি একটি উষ্ণমণ্ডলীয় উদ্ভিদ যা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *