পেঁপে একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এটি একটি উষ্ণ-প্রধান ফল। পেঁপে চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ভালো। জমিতে ভালোভাবে জল নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পেঁপে চাষের জন্য দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ভালো। জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করলে ফলন ভালো হয়।
Table of Contents
পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতি
পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতিতে নিম্নলিখিত ধাপগুলি অনুসরণ করা হয়:
জমি নির্বাচন ও প্রস্তুত
পেঁপে চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি সবচেয়ে ভালো। জমি পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত হতে হবে। জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জমিতে সার প্রয়োগের পর ১৫ দিন পর চারা রোপণ করা হয়।
জাত নির্বাচন
পেঁপে চাষের জন্য উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী জাতের বীজ বা চারা নির্বাচন করতে হবে। বাংলাদেশে চাষের জন্য কিছু উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে রয়েছে বারি পেঁপে-১ (শাহী পেঁপে), বারি পেঁপে-২ (সুলতানা পেঁপে), বারি পেঁপে-৩ (চম্পা পেঁপে) ইত্যাদি।
বীজতলা তৈরি
পেঁপে বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বীজতলা তৈরির জন্য ৫x৪ ইঞ্চি আকারের পলিথিন ব্যাগে সমান পরিমাণ বালি, মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ ভর্তি করে ব্যাগের তলায় ২-৩টি ছিদ্র করতে হবে। বীজতলায় বীজ ছিটিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজতলায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। বীজ গজানোর ১৫-২০ দিন পর চারা রোপণ উপযোগী হয়।
চারা রোপণ
দেড় থেকে দুই মাস বয়সের চারা রোপণ করা হয়। ২ মিটার দূরে দূরে চারিদিকে ২ ফুট পরিমান গর্ত তৈরি করে রোপণের ১৫ দিন আগে গর্তের মাটিতে সার মিশাতে হবে। গর্তের মাঝখানে চারা রোপণ করে মাটি দিয়ে ভালভাবে চাপা দিতে হবে। চারা রোপণের পর নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগ
পেঁপে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা জরুরি। চারা রোপণের পরপরই প্রতিটি গাছে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সার প্রয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ফল ধরার সময় প্রতিটি গাছে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও নিকাশ
পেঁপে গাছ পানি সহ্য করতে পারে না। তাই জমিতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। নিয়মিত সেচ দিয়ে জমি শুষ্ক রাখতে হবে। তবে গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আগাছা দমন
পেঁপে গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে তা নিয়মিত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। আগাছা গাছের বৃদ্ধি ও ফলন বাধাগ্রস্ত করে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
পেঁপে গাছে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে। তাই নিয়মিত গাছ পর্যবেক্ষণ করে পোকামাকড় ও রোগবালাই আক্রমণ হলে তা দমন করতে হবে।
ফল সংগ্রহ
পেঁপে গাছে ফল ধরার ৩-৪ মাস পর ফল সংগ্রহ করা হয়। ফল পরিপক্ব হলে তা পাকা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে।
ফল বিপণন
পেঁপে ফল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যায়। এছাড়াও, ফল সংরক্ষণ করে বাইরের বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে।
আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ করলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, ফলের গুণগত মানও ভালো হয়।
পেঁপে গাছ কত দূরত্বে লাগাতে হয়?
পেঁপে গাছ সারিতে লাগানোর জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২ মিটার রাখতে হবে। এভাবে লাগালে গাছের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাবে এবং ফলন ভালো হবে। তবে, পেঁপে গাছ বর্গাকার পদ্ধতিতেও লাগানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি বর্গাক্ষেত্রে ৪টি করে গাছ লাগাতে হয়। বর্গাক্ষেত্রের প্রতি পাশের দৈর্ঘ্য ২ মিটার হলে ভালো হয়।
পেঁপে গাছ লাগানোর আগে জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করে গভীরভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি গোবর সার, ৫৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ৫৫০ গ্রাম টিএসপি সার, ৫৫০ গ্রাম এমওপি সার, ২৫০ গ্রাম জিপসাম সার, ২৫ গ্রাম বোরাক্স সার এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট সার মিশিয়ে দিতে হবে।
পেঁপে গাছ রোপণের পরপরই ভালোভাবে সেচ দিতে হবে। এরপর প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। ফল ধরার পর সেচের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
পেঁপে গাছের পরিচর্যার মধ্যে রয়েছে আগাছা পরিষ্কার করা, সার প্রয়োগ করা, সেচ দেওয়া, ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করা।
আরো পড়ুন ঃ বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি
পেঁপে গাছের পরিচর্যা
পেঁপে গাছের পরিচর্যার মধ্যে রয়েছে:
- আগাছা পরিষ্কার করা: পেঁপে গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মাতে পারে। আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে। আগাছা গাছের বৃদ্ধি ও ফলন বাধাগ্রস্ত করে।
- সার প্রয়োগ করা: পেঁপে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ করা জরুরি। চারা রোপণের পরপরই প্রতিটি গাছে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সার প্রয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ফল ধরার সময় প্রতিটি গাছে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- সেচ দেওয়া: পেঁপে গাছের জন্য নিয়মিত সেচ প্রয়োজন। তবে, জমিতে যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করা: পেঁপে গাছের কিছু রোগবালাই দেখা দিতে পারে। যেমন:
- পেঁপের শুটি মোল্ড
- পাতায় হলদে মোজাইক
- পাতা কোকড়ানো
- উইল্টিং
এই রোগবালাই দমনের জন্য আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলতে হবে। এছাড়াও, নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
এছাড়াও, পেঁপে গাছের শাখা-প্রশাখা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গাছের নিচের দিকের অপ্রয়োজনীয় শাখা-প্রশাখা কেটে ফেলতে হবে। এতে গাছের বাতাস চলাচল ভালো হবে এবং ফলন ভালো হবে।
পেঁপে গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
পেঁপের ড্যাম্পিং অফ রোগ দমন
পেঁপের ড্যাম্পিং অফ রোগ একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এই রোগে গাছের গোড়া পচে যায় এবং গাছ মারা যায়। এই রোগের লক্ষণ হল:
- গাছের গোড়ায় বাদামি বর্ণের দাগ দেখা দেয়।
- দাগ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
- গাছের গোড়া পচে যায়।
- গাছ নেতিয়ে পড়ে।
এই রোগ দমনের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
- রোগমুক্ত বীজ বা চারা ব্যবহার করা।
- বীজতলায় ও জমিতে ভালোভাবে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা।
- জমিতে নিয়মিত সেচ দেওয়া। তবে, জমিতে যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- আক্রান্ত গাছ ও আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে পুড়িয়ে ফেলা।
- গাছের গোড়ায় মাটিতে বোর্ডো মিশ্রণ ছড়িয়ে দেওয়া।
- নিয়মিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করা।
ছত্রাকনাশক হিসেবে নিম্নলিখিত ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে:
- কার্বেন্ডাজিম
- কপার অক্সিক্লোরাইড
- ম্যানকোজেব
এই ঔষধ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম করে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে।
পেঁপের ড্যাম্পিং অফ রোগ দমনের জন্য এই ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে পালন করলে রোগের প্রকোপ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
পেঁপের মিলিবাগ পোকা
পেঁপের মিলিবাগ পোকা একটি ক্ষতিকারক পোকা। এটি পেঁপে গাছের পাতা, ডাল ও ফলের রস চুষে নেয়। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলন কমে যায় এবং ফলের গুণগত মান নষ্ট হয়।
পোকার বৈশিষ্ট্য:
- পোকাটি দেখতে খুব ছোট, সাদাটে বা হলদে বর্ণের হয়।
- পোকার দেহ মোমের আবরণে ঢাকা থাকে।
- পোকাটি দেখতে অনেকটা ছাতার মতো।
- পোকাটি ডালে বা পাতার নিচে থাকে।
পোকার আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতায় সাদাটে বা হলদে বর্ণের দাগ দেখা দেয়।
- পাতা কুঁচকে যায়।
- ফলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
- ফলের গুণগত মান নষ্ট হয়।
পোকা দমনের ব্যবস্থা:
- পোকা আক্রমণের শুরুতেই আক্রান্ত পাতা বা ডাল কেটে ফেলে ধ্বংস করতে হবে।
- গাছের গোড়ার মাটি থেকে ১৫-২০ সেমি উপরে স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা মুড়ে দিতে হবে যাতে মিলিমাগ গাছে উঠতে না পারে।
- সম্ভব হলে হাত দিয়ে ডিম বা বাচ্চার গাদা সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
- জৈব বালাইনাশক নিমবিসিডিন (০.৪%) ব্যবহার করা।
- পোকার আক্রমণ বেশি হলে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
কীটনাশক হিসেবে নিম্নলিখিত ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে:
- ইমিডাক্লোরোপ্রিড (এডমায়ার, টিডো)
- অ্যাসিফেট (নিরাপত্তা, ফানগোসাইড)
- সুমিথিয়ন (পাইরেক্সন, সানগর)
এই ঔষধ প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি করে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে।
পাঠকের মন্তব্য: