ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম করে। ডায়াবেটিস দুই ধরনের: টাইপ ১ এবং টাইপ ২। টাইপ ১ ডায়াবেটিস হল একটি অটোইমিউন রোগ যা অগ্ন্যাশয়কে ইনসুলিন তৈরি করতে বাধা দেয়। ইনসুলিন একটি হরমোন যা রক্তে শর্করাকে কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস হল একটি জীবনধারা রোগ যা অতিরিক্ত ওজন, অনিয়মিত ব্যায়াম এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে ঘটে।
Table of Contents
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
ডায়াবেটিস মেলিটাস, যা সাধারণত ডায়াবেটিস নামে পরিচিত, এমন একটি দীর্ঘমেয়াদী মেটাবলিক রোগ যা রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি থাকে। শরীরে ইনসুলিন নামক একটি হরমোন রয়েছে যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিসে, শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
ডায়াবেটিসের প্রধান দুটি প্রকার হল:
- টাইপ ১ ডায়াবেটিস: টাইপ ১ ডায়াবেটিস হল একটি অটোইমিউন রোগ। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলক্রমে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলিকে আক্রমণ করে, যা ইনসুলিন তৈরি করে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণত শিশুদের বা তরুণদের মধ্যে দেখা যায়, তবে যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে।
- টাইপ ২ ডায়াবেটিস: টাইপ ২ ডায়াবেটিস হল একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া যা সাধারণত ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। এটি সাধারণত অতিরিক্ত ওজন, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মতো জীবনধারা কারণগুলির কারণে হয়। টাইপ ২ ডায়াবেটিস সাধারণত ৪৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, তবে যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে।
ডায়াবেটিসের অন্যান্য প্রকারগুলির মধ্যে রয়েছে:
- গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস হল একটি অস্থায়ী অবস্থা যা গর্ভাবস্থার সময় দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণত গর্ভধারণের ৩০ সপ্তাহের পরে নির্ণয় করা হয়।
- টাইপ ৩c ডায়াবেটিস: টাইপ ৩c ডায়াবেটিস হল একটি অবস্থা যেখানে ডায়াবেটিস অন্যান্য মেডিকেল অবস্থার কারণে হয়, যেমন থাইরয়েডের সমস্যা বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ।
- টাইপ ৪ ডায়াবেটিস: টাইপ ৪ ডায়াবেটিস হল একটি বিরল অবস্থা যা সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। এটি অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষের প্রদাহের কারণে হয়।
ডায়াবেটিস এর লক্ষণ
ডায়াবেটিস হল একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা সৃষ্টি করে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন নামক একটি হরমোন প্রয়োজন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে পারে।
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি টাইপ এবং রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- অতিরিক্ত তৃষ্ণা
- ঘন ঘন প্রস্রাব
- অতিরিক্ত ক্ষুধা
- ক্লান্তি
- ওজন হ্রাস
- চোখের দৃষ্টি ঝাপসা
- ঘা না শুকানো
- ত্বকের ক্ষত
ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
- কিডনি রোগ
- হৃদরোগ
- স্ট্রোক
- দৃষ্টিশক্তি হ্রাস
- অঙ্গক্ষয়
ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল
ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল তা নির্ভর করে রক্তে শর্করার মাত্রা কোন পদ্ধতিতে মাপা হচ্ছে তার উপর।
গ্লুকোমিটারের মাধ্যমে মাপা হলে:
- খালি পেটে (Fasting blood sugar): 80 থেকে 100 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা 4.4 থেকে 5.5 মিলিমোলার/লিটার (mmol/L)
- খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর (Postprandial blood sugar): 140 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা 7.8 মিলিমোলার/লিটার (mmol/L) এর কম
ল্যাবে শিরা থেকে রক্ত নিয়ে মাপা হলে:
- খালি পেটে (Fasting blood sugar): 70 থেকে 100 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা 3.9 থেকে 5.5 মিলিমোলার/লিটার (mmol/L)
- খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর (Postprandial blood sugar): 140 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা 7.8 মিলিমোলার/লিটার (mmol/L) এর কম
এইচবিএ১সি (HbA1c) পরীক্ষার মাধ্যমে মাপা হলে:
- ৫.৭% এর কম
উল্লেখ্য যে, প্রি-ডায়াবেটিস হলে রক্তে শর্করার মাত্রা 5.5 থেকে 6.9 মিলিমোলার/লিটার (mmol/L) এর মধ্যে থাকে। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ যা রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়। রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন নামক একটি হরমোন প্রয়োজন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত ১০টি উপায় রয়েছে:
১. স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য খাদ্যতালিকা এবং শারীরিক কার্যকলাপের পরিবর্তন প্রয়োজন।
২. নিয়মিত ব্যায়াম করা: নিয়মিত ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক কার্যকলাপ বা ৭৫ মিনিট তীব্র-তীব্রতার অ্যারোবিক কার্যকলাপ করা উচিত।
৩. স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া: স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কম কার্বোহাইড্রেট, কম চর্বি এবং প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি এবং পূর্ণ শস্য খাওয়া উচিত।
৪. নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা: নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাক্তারের সাথে আপনার রক্ত পরীক্ষার রুটিন নিয়ে আলোচনা করুন।
৫. ওষুধ সেবন করা: যদি আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না হয়, তাহলে আপনার ডাক্তার আপনাকে ওষুধ দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। ওষুধের ধরন আপনার ডায়াবেটিসের ধরন এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে।
৬. ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া: টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া প্রয়োজন। ইনসুলিন রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
৭. ধূমপান না করা: ধূমপান ডায়াবেটিসের জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে আপনি আপনার স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে পারেন।
৮. স্ট্রেস কমানো: স্ট্রেস রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে। স্ট্রেস পরিচালনার কৌশলগুলি শিখতে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
৯. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ডায়াবেটিসের জটিলতা সনাক্ত করতে সাহায্য করে। আপনার ডাক্তারের সাথে আপনার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রুটিন নিয়ে আলোচনা করুন।
১০. ডায়াবেটিস সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করা: ডায়াবেটিস সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করা আপনাকে আপনার অবস্থার বিষয়ে আরও ভালভাবে বুঝতে এবং আপনার চিকিত্সার পরিকল্পনায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে সাহায্য করবে। আপনার ডাক্তার বা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি সমর্থন গোষ্ঠীর সাথে কথা বলুন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ১০টি উপায় অনুসরণ করে আপনি আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে এবং জটিলতা সৃষ্টির ঝুঁকি কমাতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনধারা পরিবর্তন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনধারা পরিবর্তন এবং ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। জীবনধারা পরিবর্তনগুলির মধ্যে রয়েছে:
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা গুরুত্বপূর্ণ।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা: ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। সপ্তাহে কমপক্ষে 150 মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম বা 75 মিনিট উচ্চ-তীব্রতার অ্যারোবিক ব্যায়াম করার লক্ষ্য রাখুন।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ: স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য এবং পাতলা প্রোটিন খাওয়ার উপর ফোকাস করুন। চিনি, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত রক্তের শর্করা পরীক্ষা করা: নিয়মিত রক্তের শর্করা পরীক্ষা করা আপনার কতটা ভালোভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করছেন তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। আপনার ডাক্তার আপনাকে আপনার রক্তের শর্করা পরীক্ষা করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি দেবেন।
ওষুধের প্রয়োজন হলে, আপনার ডাক্তার আপনাকে আপনার জন্য সঠিক ওষুধ নির্ধারণ করতে সাহায্য করবেন। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের জন্য, ইনসুলিন প্রয়োজন। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য, ওষুধের বিভিন্ন ধরন উপলব্ধ, যেমন ওরাল ডায়াবেটিক ওষুধ, ইনসুলিন এবং ইনসুলিন-প্রম্প্টিং অ্যামিনো অ্যাসিড (জিএলপি-১) অ্যাগোনিস্ট।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে, যেমন:
- হার্ট অ্যাটাক
- স্ট্রোক
- কিডনি রোগ
- অন্ধত্ব
- পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ
- নিউরোপ্যাথি
- গ্যাংগ্রেন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য, আপনার ডাক্তারের সাথে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। তারা আপনাকে আপনার জন্য সঠিক জীবনধারা পরিবর্তন এবং ওষুধের পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য: