অতিরিক্ত ওজন নারী বা পুরুষ উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। বর্তমানে জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যা বেড়েই চলেছে।
অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য অনেকেই নানা ধরনের ডায়েট করেন। তবে, ডায়েট মানে খাবার না খাওয়া বা খাবারের পরিমাণ অতিরিক্ত কমিয়ে দেওয়া নয়। ডায়েট হলো একজন ব্যক্তির শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ। সুষম খাদ্য গ্রহণ ব্যক্তির ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
সুষম খাদ্য তৈরিতে একজন ব্যক্তির বয়স, ওজন, উচ্চতা, কাজের ধরন, লিঙ্গ ইত্যাদি বিবেচনা করে ব্যক্তির প্রয়োজনীয় দৈনিক ক্যালরি নির্ধারণ করা হয়। সুষম খাদ্যে ফল, শাকসবজি, সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার, lean প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি থাকে। এসব খাবার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত ওজন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। ওজন কমানোর উপায় গুলোর মধ্যে সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং শারীরিক কার্যকলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আসুন জেনে নেই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে যেভাবে কমাবেন আপনার ওজন—
Table of Contents
অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের কারণ
অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের অনেকগুলি কারণ রয়েছে। সর্বাধিক সাধারণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ: অতিরিক্ত খাওয়া বা অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়া অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের প্রধান কারণ।
- অনিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ: শারীরিক কার্যকলাপ শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি পোড়াতে সাহায্য করে। অনিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের একটি অন্যতম কারণ।
- জেনেটিক কারণ: কিছু ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের কারণ হতে পারে জেনেটিক কারণ।
- স্বাস্থ্যগত সমস্যা: কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যেমন থাইরয়েড সমস্যা, অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের কারণ হতে পারে।
অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলির মধ্যে রয়েছে:
- হৃদরোগ: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন হৃদরোগ, যেমন স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
- স্ট্রোক: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
- ডায়াবেটিস: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
- কিডনি রোগ: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- ক্যান্সার: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন কিছু ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অস্টিওআর্থারাইটিস: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন অস্টিওআর্থারাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: অতিরিক্ত শারীরিক ওজন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার, যেমন বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতিরিক্ত শারীরিক ওজন কমাতে হলে খাদ্যতালিকা পরিবর্তন এবং শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।
ওজন কমানোর উপায়
ওজন কমানোর জন্য দুটি প্রধান উপায় হল খাদ্যতালিকা পরিবর্তন এবং শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি।
খাদ্যতালিকা পরিবর্তন
ওজন কমানোর জন্য খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যতালিকায় কম ক্যালোরি এবং বেশি পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে।
খাদ্যতালিকায় যেসব খাবার কমাতে হবে:
- চিনিযুক্ত পানীয়: সফট ড্রিংক, কোমল পানীয়, জুস, শরবত ইত্যাদি চিনিযুক্ত পানীয় ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এগুলি কম খাওয়া উচিত।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: ফাস্ট ফুড, বেকারি খাবার, প্যাকেটজাত খাবার ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি ক্যালোরিযুক্ত এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এগুলি এড়িয়ে চলা উচিত।
- স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার: লাল মাংস, দুগ্ধজাত খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এগুলি কম খাওয়া উচিত।
- অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার: ভাত, রুটি, পাস্তা, আলু ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এগুলি কম খাওয়া উচিত।
এছাড়াও, অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার, অতিরিক্ত ভাজা খাবার, অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার ইত্যাদিও ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এগুলিও কম খাওয়া উচিত।
ওজন কমানোর জন্য শুধু খাবার কমানোই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি শারীরিক কার্যকলাপও বাড়াতে হবে। সপ্তাহে কমপক্ষে 150 মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করা উচিত।
খাদ্যতালিকায় যেসব খাবার বাড়াতে হবে:
ওজন কমাতে খাদ্যতালিকায় যেসব খাবার বাড়ানো উচিত তার বিস্তারিত বিবরণ:
- ফল: ফলগুলি কম ক্যালোরিযুক্ত এবং বেশি পুষ্টিকর। এগুলিতে ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। ফলগুলি ওজন কমাতে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- শাকসবজি: শাকসবজিও কম ক্যালোরিযুক্ত এবং বেশি পুষ্টিকর। এগুলিতে ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। শাকসবজি ওজন কমাতে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার: সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার কম ক্যালোরিযুক্ত এবং বেশি ফাইবারযুক্ত। এগুলিতে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার ওজন কমাতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
- lean প্রোটিন: lean প্রোটিন, যেমন মাছ, মুরগির মাংস, ডিম, ডাল ইত্যাদি কম ক্যালোরিযুক্ত এবং বেশি পুষ্টিকর। এগুলিতে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। lean প্রোটিন ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- বাদাম, বীজ, ওটমিল, দই, টক দই: বাদাম, বীজ, ওটমিল, দই, টক দই ইত্যাদি কম ক্যালোরিযুক্ত এবং বেশি পুষ্টিকর। এগুলিতে ফাইবার, প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এই খাবারগুলি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি
ওজন কমানোর জন্য ব্যায়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যায়াম শরীরের মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ক্যালোরি পোড়াতে সাহায্য করে। ওজন কমানোর জন্য কার্যকর কিছু ব্যায়াম হল:
- হাঁটা: হাঁটা একটি সহজ এবং কার্যকর ব্যায়াম। প্রতিদিন কমপক্ষে 30 মিনিট হাঁটা ওজন কমানোর জন্য সাহায্য করে।
- দৌড়ানো: দৌড়ানো একটি উচ্চ-তীব্রতার ব্যায়াম। এটি শরীরের মেটাবলিজম বাড়ায় এবং দ্রুত ক্যালোরি পোড়াতে সাহায্য করে।
- সাইকেল চালানো: সাইকেল চালানো একটি আরামদায়ক এবং কার্যকর ব্যায়াম। এটি হাঁটার মতোই উপকারী।
- নাচ: নাচ একটি মজার এবং কার্যকর ব্যায়াম। এটি শরীরের সমস্ত পেশীকে কাজ করে এবং ক্যালোরি পোড়াতে সাহায্য করে।
- স্বচ্ছন্দ ব্যায়াম: স্বচ্ছন্দ ব্যায়াম হল এমন ব্যায়াম যা আপনি উপভোগ করেন। এটি হতে পারে যোগব্যায়াম, জিমনাস্টিক, সাঁতার, ইত্যাদি। স্বচ্ছন্দ ব্যায়াম আপনাকে নিয়মিত ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করবে।
ওজন কমানোর জন্য ব্যায়াম করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখবেন:
- সপ্তাহে কমপক্ষে 150 মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করুন।
- আপনার শরীরের সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যায়াম করুন।
- ধীরে ধীরে ব্যায়াম শুরু করুন এবং আস্তে আস্তে সময় বাড়ান।
- ব্যায়াম করার আগে এবং পরে হালকা উষ্ণতা এবং শীতলীকরণ করুন।
ওজন কমানোর জন্য খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি শারীরিক কার্যকলাপও বাড়াতে হবে। সপ্তাহে কমপক্ষে 150 মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করা উচিত।
দ্রুত ওজন কমানোর উপায়
দ্রুত ওজন কমানোর জন্য উপরে বর্ণিত উপায়গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে, দ্রুত ওজন কমানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই দ্রুত ওজন কমাতে হলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
ওজন কমানোর কিছু অতিরিক্ত টিপস
- পর্যাপ্ত ঘুম নিন। ঘুম কম হলে শরীরের মেটাবলিজম কমে যায়, যা ওজন বাড়ায়।
- পানি বেশি পান করুন। পানি শরীরের টক্সিন বের করে দেয় এবং মেটাবলিজম বাড়ায়।
- মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করুন। মানসিক চাপ শরীরে স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে, যা ওজন বাড়ায়।
ওজন কমানোর জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। নিয়মিত খাদ্যতালিকা পরিবর্তন এবং শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ওজন কমানো সম্ভব।
ব্যায়াম না করে ওজন কমানোর উপায়
ব্যায়াম না করে ওজন কমানোর জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে পারেন:
- খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনা: ওজন কমানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনা। আপনার দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হবে। এর জন্য আপনি নিম্নলিখিত বিষয়গুলি করতে পারেন:
- চিনিযুক্ত পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার, অতিরিক্ত ভাজা খাবার, অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
- ফল, শাকসবজি, সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার, lean প্রোটিন, বাদাম, বীজ, ওটমিল, দই, টক দই ইত্যাদি খাবার খান।
- প্রতিদিন ছোট ছোট খাবার খান। এতে আপনার শরীরে ক্যালোরির পরিমাণ কমে যাবে।
- খাওয়ার সময় ধীরে ধীরে খান এবং চিবিয়ে খান। এতে আপনার ক্ষুধা বোধ কমবে।
- খাবার খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান করুন। এতে আপনার ক্ষুধা বোধ কমবে।
- ওষুধপত্র: কিছু ওষুধ ওজন কমানোর জন্য সাহায্য করতে পারে। তবে, এ ধরনের ওষুধপত্র সেবনের আগে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- সার্জারি: ওজন কমাতে সাহায্য করার জন্য কিছু সার্জারি রয়েছে। তবে, এ ধরনের সার্জারির অনেক ঝুঁকি রয়েছে। তাই, এ ধরনের সার্জারির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ সার্জনের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপসংহার:
স্বাস্থ্যকর ওজন কমানোর জন্য সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং শারীরিক কার্যকলাপের পাশাপাশি মানসিক চাপ কমানোও গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপ ওজন বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। তাই মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম, ধ্যান বা মেডিটেশনের মতো কার্যকলাপগুলি অনুশীলন করতে পারেন।
পাঠকের মন্তব্য: