লটকনের উপকারিতা জানেন কি? লটকন বা নটকোনা যার বৈজ্ঞানিক নাম: (Baccaurea motleyana)। এটি এক প্রকার টক মিষ্টি ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি এবং বি-২ আছে, এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত- Rambai, Rambi, Mafai-farang, Lamkhae, Ra mai ইত্যাদি। গাছটি দক্ষিণ এশিয়ায় বুনো গাছ হিসেবে জন্মালেও বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বাণিজ্যিক চাষ হয়।
বৈজ্ঞানিক বর্ণনা
লটকন একটি মাঝারি আকৃতির চির সবুজ বৃক্ষ। গাছের উচ্চতা ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। পাতা লম্বা ও সরু, আয়তাকার বা ডিম্বাকার। ফুল ছোট, সাদা বা হলুদ রঙের। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার, পাকলে হলুদ বা কমলা রঙ ধারণ করে। ফলের খোসা পাতলা, ভিতরে রসালো ও অম্লমধুর স্বাদের বীজ থাকে। প্রতিটি ফলের মধ্যে সাধারণত ৩-৪টি বীজ থাকে।
Table of Contents
লটকন চাষ পদ্ধতি
লটকনের চাষ সাধারণত শুষ্ক ও আর্দ্র উভয় ধরনের জমিতে করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ মাটি লটকনের চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। লটকনের চারা রোপণের উপযুক্ত সময় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। চারা রোপণের পরপরই সেচ দিতে হবে। লটকন গাছকে প্রতি বছর ১-২ বার সার প্রয়োগ করতে হয়।
লটকনের চাষের উপযুক্ত মাটি:
লটকন চাষের জন্য দোআঁশ, বেলে দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি ভালো। মাটির pH ৫.৫ থেকে ৬.৫ হওয়া উচিত।
লটকনের চাষের সময়:
বাংলাদেশে সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে লটকনের চারা রোপণ করা হয়। তবে বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে গাছ লাগানো যায়।
লটকনের চারা রোপণ:
লটকনের চারা রোপণের আগে ৬০x৬০x৬০ সেমি মাপের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের মাটি ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। গর্তের মাঝখানে চারাটি বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে।
লটকনের পরিচর্যা:
লটকনের গাছের পরিচর্যার মধ্যে রয়েছে:
- সেচ: লটকনের গাছে প্রচুর পানি প্রয়োজন। তাই গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দিতে হবে।
- সার প্রয়োগ: লটকনের গাছে বছরে তিনবার সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথমবার বৈশাখ মাসে, দ্বিতীয়বার আষাঢ় মাসে এবং তৃতীয়বার ভাদ্র মাসে। প্রতিবার গাছের গোড়ায় ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমপি ও ৫০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।
- আগাছা পরিষ্কার: লটকনের গাছের গোড়ায় আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।
- পোকামাকড় দমন: লটকনের গাছের পোকামাকড় দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
লটকনের পুষ্টিগুণ
লটকন একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে রয়েছে:
- ক্যালরি: ৯২ কিলোক্যালরি
- প্রোটিন: ১.৪২ গ্রাম
- শর্করা: ১৩৭ গ্রাম
- চর্বি: ০.৪৫ গ্রাম
- ভিটামিন সি: ১৭৮ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম: ১৭৭ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৬৯ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি১: ১৪.০৪ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি২: ০.১৯ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি
লটকন একটি ভালো ভিটামিন সি এর উৎস। ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
পটাশিয়াম
লটকনে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি। পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়াও পটাশিয়াম পেশী ও স্নায়ুর কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ক্যালসিয়াম
লটকনে ক্যালসিয়ামের পরিমাণও ভালো। ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
ভিটামিন বি১
লটকনে ভিটামিন বি১ এর পরিমাণ ভালো। ভিটামিন বি১ শরীরের শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। এছাড়াও ভিটামিন বি১ নার্ভাস সিস্টেমকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন বি২
লটকনে ভিটামিন বি২ এর পরিমাণ ভালো। ভিটামিন বি২ শরীরের কোষগুলোর বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়াও ভিটামিন বি২ ত্বক, চুল ও নখের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
লটকনের ঔষধি গুণ
লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। এই উপাদানগুলোর কারণে লটকন বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
লটকনের ঔষধি গুণসমূহ
- রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে: লটকনে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই লটকন খেলে রক্তশূন্যতা দূর হয়।
- রুচি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে: লটকন একটি অম্ল মধুর ফল। তাই এটি খেলে মুখের স্বাদ বৃদ্ধি পায় এবং খাবারের রুচি বাড়ে।
- হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে: লটকনে প্রচুর পরিমাণে আঁশ রয়েছে। আঁশ হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই লটকন খেলে ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যা দূর হয়।
- হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে: লটকনে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রক্তনালীতে জমে থাকা কোলেস্টেরল দূর করে হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে: লটকনে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: লটকনে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই লটকন খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী: লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। ভিটামিন সি ত্বকের কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে। কোলাজেন ত্বককে মসৃণ ও সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।
- মানসিক অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে: লটকনে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরের স্ট্রেস হরমোন কমাতে সাহায্য করে। তাই লটকন খেলে মানসিক অবসাদ দূর হয়।
আরো পড়ুন ঃ
লটকনের উপকারিতা
লটকন একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এটি নিয়মিত খেলে শরীরের বিভিন্ন উপকারিতা পাওয়া যায়। লটকনের উপকারিতা সমুহ নিম্নরূপ:
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- চর্মরোগ প্রতিরোধ: লটকনে থাকা ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চর্মরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- হাড়ের স্বাস্থ্য: লটকনে থাকা ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য: লটকনে থাকা পটাসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- রক্তশূন্যতা দূরীকরণ: লটকনে থাকা আয়রন রক্তশূন্যতা দূরীকরণে সাহায্য করে।
- রুচি বৃদ্ধি: লটকন একটি টক-মিষ্টি স্বাদের ফল যা রুচি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- বমি বমি ভাব দূরীকরণ: লটকন বমি বমি ভাব দূরীকরণে সাহায্য করে।
- ডায়রিয়া প্রতিরোধ: লটকনে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ডায়রিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।
লটকনের কিছু ঔষধি গুণাগুণও রয়েছে। লটকনের পাতা ও ছাল ডায়রিয়া, আমাশয়, কৃমি ও অন্যান্য পেটের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
লটকন গাছে কত দিনে ফল আসে?
লটকন গাছে ফল আসার সময় নির্ভর করে গাছের বয়স, চারা রোপণের পদ্ধতি, পরিচর্যা ইত্যাদির উপর। সাধারণত, কলমের গাছে চার বছর বয়সেই ফল আসা শুরু হয়। তবে, চারার ক্ষেত্রে ফল আসা শুরু হতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগে। ভালো পরিচর্যা করলে গাছ ছোটবেলায়ই ফল দিতে শুরু করতে পারে।
লটকন গাছে ফুল ফোটে মার্চ-এপ্রিল মাসে। ফুল থেকে ফল পাকে জুলাই-আগস্ট মাসে। অর্থাৎ, চারা রোপণের পর থেকে চার থেকে সাত বছরের মধ্যে ফল পাওয়া যায়।
লটকন গাছে ফলন ভালো হওয়ার জন্য গাছের সঠিক পরিচর্যা করা জরুরি। গাছের গোড়ায় মাটি সবসময় ভেজা থাকতে হবে। গাছের ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় গোবর বা জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
পাঠকের মন্তব্য: