‘ফিটিং মনির’! আয়ের লোভ দেখিয়ে লোকজনকে ব্যাবসায়িক অংশীদার করা, তারপর সেই ব্যবসাকে ধীরে ধীরে ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়ে একদিন পুরো মালিকানা নিজের করে নেওয়া—এই কাজে জুড়ি নেই ফরিদপুরের মৃধা মনিরুজ্জামানের। এই কৌশলে গত এক যুগে তিনি তিনটি জুট মিলসহ অন্তত সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন, আর পথে বসেছেন তাঁর একসময়ের অংশীদাররা। দুদকের মামলায় জামিন নিতে যাওয়ার পর জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক এই সহসভাপতিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ খবরে স্বস্তি নেমে এসেছে এলাকায়।
ফিটিং মনির এর আগেও দুদকের মামলায় বেশ কয়েক মাস জেল খেটেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের অন্যতম অর্থায়নকারী মনিরের বিরুদ্ধে ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাতের একটি মামলায়ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
গত ১ মার্চ একজন প্রবাসী উদ্যোক্তা তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও হত্যার হুমকির অভিযোগ এনে মামলা করেন রাজধানীর বনানী থানায় (নম্বর-২)। মামলাটি এখন সিআইডিতে তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানা যায়। এবার দুদকের মামলায় জেলে যাওয়ার খবর পেয়ে ভুক্তভোগীরা তাঁকে প্রতারণার মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি তুলেছেন।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, ফরিদপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলার (নম্বর ০২/২১) আসামি মৃধা মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অবৈধ আয়ের প্রমাণ পেয়ে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালতে হাজির হলে তাঁকে ফরিদপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, যুবদলের সাবেক এই নেতার দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই। ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আয়কর রিটার্নের একটি প্রতিবেদন তিনি দুদকে জমা দিয়েছিলেন। রিটার্ন পর্যালোচনা করে দুদক ৯৮ লাখ টাকা অবৈধ আয়ের প্রমাণ পায়। এরপর দুদকের সহকারী পরিচালক রাজকুমার সাহা ২০১৯ সালের ২৭ মে দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ৩০ জুলাই কারাগারে যান মৃধা মনিরুজ্জামান। থাকতে হয় কয়েক মাস।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মৃধা মনিরুজ্জামান লাভজনক ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে বিত্তশালীদের নিয়ে প্রথমে একটি কম্পানি করেন। পরে ওই প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়ের মধ্যে ‘অলাভজনক’ দেখাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে ব্যবসার অন্য অংশীদারদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে শেয়ার কিনে নেন নিজেই।
সৌদিপ্রবাসী একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে মৃধা মনিরুজ্জামান ফরিদপুরের মধুখালীতে দাহমাশি জুট মিল গড়ে তোলেন। পরে নিজের পাট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম দামে নিম্নমানের পাট দিয়ে বাড়তি দাম দেখিয়ে ওই টাকা হাতিয়ে নেওয়া, পাট সরবরাহ না করেও বিল উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। মনিরুজ্জামান কম্পানির টাকায় কেনা পাট দিয়ে উৎপাদিত সুতা চোরাইপথে ভারতে পাচার করে দেন।
এ ছাড়া ভালো সুতা নষ্ট দেখিয়েও তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এভাবে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা অনিয়ম করার বিষয়টি পরে কম্পানির অডিটে ধরা পড়ে। এ অবস্থায় তিনি ওই মিলের শেয়ার (অংশ) নির্ধারিত দামে মূল উদ্যোক্তার কাছে বিক্রি করে দেন। এখন মৃধা মনিরুজ্জামান আবার মিলটি দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি মাঝে-মধ্যেই বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের দিয়েও দখলের হুঁমকি দিচ্ছেন।
দাহমাশির মতো গোল্ডেন ও প্রাইড জুট মিল নামের দুটি কারখানার মাধ্যমেও মৃধা মনিরুজ্জামান ও তাঁর ছেলে মেহেদি জামান সনেট ব্যবসায়ের এই বৈরী সময়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। দুটি মিলেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৃধা মনিরুজ্জামান।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে গত এক যুগে তিনি তিনটি জুট মিলসহ অন্তত সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে রয়েছে তাঁর আরো ছয়টি পাট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
পাঠকের মন্তব্য: